ভালবাসার গল্প : ঝিঁঝি পোকার ডাক

ভালবাসার গল্প : ঝিঁঝি পোকার ডাক

লিখেছেনঃ মারুফ হোসেন

আমি চেয়ারে একপাশে বসে আছি। আমার পাশে যে মেয়েটা বসে আছে তার নাম নীরা।
অনেকক্ষণ ধরে পাশাপাশি বসে আছি, অথচ দুজনই চুপচাপ। সারাবছর পত্রিকা না পড়লেও গাড়ীতে উঠার আগে পত্রিকা নেওয়া আমার জন্য বাধ্যতামূলক। আমি একবার পত্রিকার এপাতা আরেকবার ওপাতায় যাচ্ছি। কোন এক অজানা কারণে পিচ্চি গুলা টাকা খোঁজার জন্য পাশের জনকে রেখে আমার কাছে চলে আসে। যদিও আমি দেখতে মোটেও টাকাওয়ালা টাইপ না। শুনেছি টাক মাথা হলে নাকি টাকাওয়ালা টাইপ মনে হয়। টাক হওয়ার সমুদয় সম্ভাবনা থাকলেও এখনো তা হইনি।

দূর থেকে গানের আওয়াজ আসছে। যে বাজাচ্ছে তাকে গিয়ে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছেকরছে। একের পর এক সময় সাপেক্ষীক গান বাজিয়ে যাচ্ছে। আরজে হলে নিশ্চিত হিট হয়ে যেত। একসময় আশপাশের দোকান গুলো থেকে একইসঙ্গে “ও প্রিয়া” গানটা বাজতো। তখন ছেলেপেলেদের মনের অবস্থার সাথে মিলে যাওয়াতে হিট হয়ে গেল। এখন হলে নিশ্চয় হত না? ছেলেপেলেরা ডিজিটাল হয়েছে। শিল্পী আসিফকে কাছে পেলে একটা প্রশ্ন করতাম, “ভাই সব মেয়েদের নাম দিয়ে গান গাইলেন, ছেলেরা কি দোষ করল। আপনাদের জন্যই সম-অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে না।”

গান পরিবর্তন হয়েছে। “তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা?” আমি নীরার দিকে চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। নীরা জনাব দেওয়ার আগেই আবার প্রশ্ন করলাম, “আচ্ছা মনের ঘরে কয়জন বসত করতে পারে?” নীরা অপেক্ষা না করেই জবাব দিল ” একশ এক জন। একশ জন অপশনাল, একজন মেইন সাবজেক্ট।”
আমি হো হো করে হাসতে শুরু করলাম। মন খারাপ থাকলেও নিজের স্বভাবসুলভ কথার সাথে সাথেই উত্তর দেওয়া বন্ধ হয়নি। তখন আমার আরেকবার মনে হল, “মানুষ সত্যিই খোলস বদলায়, নিজে বদলায় না।”
“তুমি আমার চাইতে ওকে বেশি পছন্দ করো? ”
আমি হাসি থামালাম, কিন্তু জবাব দিলাম না। সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে হয় না।
প্রশ্নকর্তা উত্তর আশাও করেনা। নীরা আমার জবাবের অপেক্ষা না করেই আবার
বলল, “আমি তোমাকে ওর চাইতে বেশি পছন্দ করি, এটা তুমি জানো? ”
আমি এবারো জবাব দিলাম না। একবার শুধু ফিরে তাকালাম। চোখে নাকি সব
প্রশ্নের উত্তর লেখা থাকে।

চঞ্চল কিন্তু কোমল এই মেয়েটার সাথে আমার প্রথম পরিচয় ট্রেনে। আমাকে
ট্রেনে জানালার পাশের সিটে বসতেই হবে। গল্পের নায়িকর মত জানালার পাশের সিট নিয়ে ঝগড়া হয়নি। আমি জানালার পাশে বসে পত্রিকার পৃষ্ঠা মেলে মুখের সামনে ধরে আছি। সামনে কেউ একজন পত্রিকায় টোকা দিল। আমি “কি” জিজ্ঞেস করার আগেই মেয়েটা বলে উঠল, “খেলার পাতাটা দাও তো”। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে
খেলার পাতাটা দিয়ে দিলাম। আমার নিচের চোয়াল ততক্ষণে ঝুলে গেছে কিনা তা খেয়াল করিনি। আমার ধারণা ছিল, খেলাধুলা ব্যাপারটা মেয়েদের আগ্রহের বাইরে।
তার উপর তার চাওয়ার ভঙ্গিমা! তার পাশে বসে থাকা ছেলেটা ঠিক আমার মত করে কিন্তু দুঃখী দুঃখী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মায়া জিনিসটা মেয়েদের জন্য, কিন্তু ছেলেটার মাঝে একধরণের মায়া আছে। দেখলেই মায়া লাগে মত।
ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় যাবেন? ”
“জানিনা।”
“মানে?” এবার নিশ্চিত, আমার চোয়ালের নিচের পাটি ঝুলে গেছে।
ছেলেটা করুণ চোখে মেয়েটার দিকে তাকাল। মেয়েটা পত্রিকার দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল, “জানিনা কতটুকু যাবো। ট্রেনে চড়তে ইচ্ছে করছে, টিকেট কেটে উঠে পড়লাম। ইচ্ছা মিটে গেলেই নেমে যাবো।”
আমি কি বলব খুঁজে পেলাম না। মনের অজান্তে “বেচারা” শব্দটা চলে আসলো।
মেয়েটা মুখে হাসি রেখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাদের সাথে যাবে? আমরা প্রায় সবাই মিলে ঘুরতে বেড়াই। পরের স্টেশনের আমাদের আরো কিছু ফ্রেন্ড উঠবে। ভাল লাগবে।”
আমি বললাম, “না, এখন ট্রেন মিস হলে পরের ট্রেনে দাঁড়িয়ে যেতে হবে।”
মেয়েটা হেসে বলল, “আমার পাশে একটা হাবলা আছে তো, তাই তাকে আমাদের গ্রুপে বিশেষ কেউ মনে হয়। তুমি থাকলে দুজন হলে আর বিশেষ কেউ মনে হবে না।”
আমি অবাক চোখে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। খুব কঠিন কিছু কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে করল, কেন যেন পারলাম না। সেখানেই নীল ভাই আর নীরার সাথে পরিচয়। নীল রং আমার ভারী পছন্দের। নীল শাড়ীর সাদা আঁচলে কোন তরুণীকে কল্পনা করতে ভালোই লাগে। আমি হেসে বললাম, “আপনি প্রতিবার বিবাহবার্ষিকীতে ভাবীকে একটা করে নীল শাড়ী দিবেন। ব্যাপারটা মজার হবে।” নীল ভাই জবাবে মৃদু হেসে নীরার দিকে একটু করে তাকালো। নীরা বলল, “আমাকে আপনি আপনি করবে
না। আমিও করিনা, আমাকে করলেও ভাল লাগে না।” আমি হেসে বললাম, “আচ্ছা।”

নীরা সম্ভবত ঠিকই বলেছিল। পরের স্টেশনে তাদের আরো কিছু বন্ধু উঠল। সবাই খুব মজার মানুষ হলেও নীল ভাইয়ের সাথে আমার কেন যেন একটু বেশিই ঘনিষ্ঠতা হল। নীল ভাই আমার দিকে ঝুঁকে এসে বলল, ” ট্রেন জার্নির মজা কি জানো?
ট্রেনের শব্দের আলাদা একটা মজা আছে। তুমি মনে মনে যা বলবে, শব্দটাও তোমার সাথে তাই বলবে। ধরো, তুমি মনে মনে বললা, নীরা নীরা। দেখবে ট্রেনের শব্দটাও তোমার সাথে নীরা নীরা বলা শুরু করে দিয়েছে। কখনো রাতে ট্রেনে চললে ট্রাই করে দেখবা।”
আমি সাথে সাথেই ট্রাই করা শুরু করলাম। নীরা হেসে বলল, “বলছিলাম না, দুটাই একরকম। মিলবে ভাল। চলে আসো আমাদের সাথে।” আমি নিজেকে অবাক করে দিয়ে তাদের সাথে নেমে গেলাম। আমি মিশুক টাইপ মানুষ না হলেও নীরার কল্যাণের তাদের সাথে খুব ভাল ভাবে মিশে গেলাম। সবাইকে খোঁচা দিয়ে কথা বলানোতে তার জুড়ি নেই।

আমরা নেমে একটা হোটেলে নাস্তা করতে বসলাম। হোটেলে ঢুকার আগে নীল ভাই বলল, “এই হোটেলে যাবো না। সামনে আরো ভাল হোটেল থাকতে পারে।”
কেউ দ্বিমত করলো না। নীরা রেগে বলল, “তিনি নবাবজাদা ছলিমুল্লা হইছে। উনার জন্য এখানে ফাইভস্টার হোটেল বসাবে।”
আমরা সবাই হোটেলে বসলাম। নীল ভাই ক্ষুধা নেই বলে কিছু খেলোনা। খাওয়া শেষে সবাই বের হয়ে গেলে নীরা আমাকে ডেকে নিয়ে মৃদু হেসে বলল, “তুমি গিয়ে বলো, তুমি বললে খাবে। সকাল থেকে কিছু খায় নাই। এর থেকে খারাপ জায়গায় বসেও খায়। এখন আমি বলাতে গায়ে লেগে গেছে। মেয়েদের মত অভিমান, বুঝলা? ”
আমি অবাক হয়ে, “আমি কেন? ” টাইপ লুক দিলাম।
নীরা সেভাবে হেসে বলল, “ওর কি ভাল লাগে, কাকে ভাল লাগে আমার চেয়ে কে ভাল বুঝবে? ”
আমি “আচ্ছা ঠিক আছে” টাইপ হাসি দিয়ে নীল ভাইয়ের কাছে চলে গেলাম।
কাকতালীয় ভাবে আমাদের পাশের এলাকায়ই নীল ভাইদের বাসা। মাঝে মাঝেই কথা হত।

একদিন রাত এগারোটার দিকে নীল ভাইয়ের কল। কিছু বলার আগেই নীল ভাই হড়বড় করে বলল, “কোন সমস্যা না থাকলে বের হয়ে আসো। রাতে ঘুরার অভ্যাস আছে?” আমার রাতে বের হওয়ার অভ্যাস না থাকলেও কেন যেন বের হয়ে গেলাম। আমরা হেঁটে গিয়ে একটা ব্রিজের উপর বসলাম। নীল ভাই বলল, “মোবাইলটা বন্ধ করে দিলাম।”
আমি বললাম, “তাহলে কি আমারটাও বন্ধ করে দিব? ”
“না, তোমারটা বন্ধ থাকলে নীরা বুঝে যাবে তোমার সাথে আছি।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “আমাকে কেন কল দিবে? ”
নীল ভাই নরম গলায় বলল, “তুমি বুঝোনা বলেই তো তোমার সাথে বসে আছি।”
আমি অবাক চোখে নীল ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ছেলেটাকে কেমন অচেনা লাগছে। নীল ভাই চাঁদের ঝাপসা আলোতে আমার অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা ঠিক দেখছিল কিনা বুঝতে পারলাম না।

জীবন ব্যস্ততায় হঠাৎ করে খুব ব্যস্ত হয়ে গেলাম। অনেকদিন নীল ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ হল না। একদিন সকালে নীল ভাই কল করে বলল এয়ারপোর্ট রোডে আসতে।

সেখানে গিয়ে দেখি নীল ভাই চলে যাচ্ছে। আমি ছাড়া আর কেউ নেই। নীল ভাইকে সেবার প্রথম অনেকখানি আপন মনে হতে লাগল। নীল ভাই আমার হাত দুহাতে শক্ত করে ধরে বলল, ” ঝিঁঝি পোকার ডাক শুনেছ? না শুনলে খুব একটা কানে লাগে না। একবার মন দিয়ে শুনলে আর না শুনে থাকা যায়না। তখন সে জায়গা ছেড়ে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকেনা।”
আমার খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করলো, “সে জায়গা ছেড়ে গেলে ঝিঁঝি পোকার ডাক শুনা থেকে বাঁচা যায়। মনের ভিতর যে ডেকে বেড়ায়, তার ডাক থেকে কোথায় গেলে বাঁচা যায়? ” নীল ভাইয়ের ছলছল চোখ দেখে সে প্রশ্ন আর করা হয়নি। কারো কষ্ট কাউকে ছুয়ে যায় না। কষ্ট ঘাম হতে পারে, কষ্ট শুনা মানুষ গুলো রুমাল হতে পারে না। সেদিন আমাকে ছুয়ে গিয়েছিল। সত্যিই ছুয়ে গিয়েছিল।
ঝিঁঝি পোকার ডাক সেদিন নীরা শুনেছিল কিনা নীল ভাইয়ের জানা ছিল না। নামহীন সম্পর্ক গুলো হয়তো এভাবেই বেনামে হারিয়ে যায়। হারিয়ে যেতে হয়। তাদের যে কোন পরিচয় নেই।

আমরা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। এয়ারপোর্ট পোঁছাতে এখনো আধঘণ্টা লাগবে।

লিখেছেনঃ মারুফ হোসেন

Related posts

Leave a Comment